রাজনীতি
  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা
  01-07-2016

 

 

বিশেষ প্রতিবেদক :

 

গুম, অপহরণ, নিখোঁজ, খুন, ধর্ষণ ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা রোজ উঠে আসছে গণমাধ্যমে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দেশি-বিদেশি সংগঠনগুলো এসব নিয়ে তাদের উদ্বেগ জানিয়ে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে। তাদের বক্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই উদ্বেগ।

অপরদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাণহানির নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সোয়া শতাধিক প্রাণহানির পরও অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু ও সন্তোষজনক হয়েছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে দেশীয় সংস্থার সাথে সুর মিলিয়ে প্রায় অভিন্ন অভিমত দিচ্ছে মানবাধিকার বিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার সমস্যা বর্তমানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে সঠিক পরিবেশের অভাব ও শ্রমিক অধিকারের দুর্বল অবস্থা। বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, খুন, গুম ও অপহরণের ঘটনাও চলছে। নিয়ম না মেনে গ্রেফতার, নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ, সভা-সমাবেশ ও বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও সরকারের হয়রানির ভয়ে একাধিক সাংবাদিকের সমালোচনার পথ পরিহার করে আত্মনিষেধাজ্ঞার পথ বেছে নেওয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সহিংসতা, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাও বন্ধ হয়নি।

সংস্থাগুলো বলছে মানবাধিকারের এ চিত্র কোনোমতেই জনগণের কাঙ্ক্ষিত নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরের মতো এসব বিষয় অস্বীকার না করে প্রতিবিধানমূলক উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছে তারা।

মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ‘অধিকার’ তাদের জুন মাসের প্রতিবেদনে বলেছে, গুম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার। এটি মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

তাদের ২০১৬ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা প্রদান করে চলেছে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় মদদে চলছে রাজনৈতিক সহিংসতা। দেশের স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারিদলের পক্ষে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ব্যাপক অনিয়মের সাথে জড়িত। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকদের পায়ে গুলি করার প্রবণতা, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করার অভিযোগের তালিকাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’র জুন মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। মে মাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় হতাহত, নারী নির্যাতন, গণধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, গৃহকর্মী নির্যাতন, পারিবারিক কোন্দলে হতাহত ও খুন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গতমাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৫৯ জন এবং আহত হয়েছে ১৩৩২ জন। একই মাসে সামাজিক সহিংসতায় ৪৩ নিহত ও আহত হয়েছেন ১৪৭ জন। এছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক কারণে আহত ৪৮ জন ও নিহত হন ৪ জন। বিভিন্ন কারণে হত্যার শিকার হয়েছে ১৪ শিশু।

ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪০ জন নারী ও শিশু । এদের মধ্যে শিশু ২১ জন। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের প্রথম তিন মাসে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ২০ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৪ জনকে।

রিপোর্টে আরো বলা হয়, গত মে মাসে সন্ত্রাসী ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হয়েছে ৭৪ জন ও আহত হয় ৩৮ জন। টাঙ্গাইলে নিখিল জোয়ার্দার নামে এক দর্জিকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা । এ মাসেই বান্দরবনে এক বয়স্ক বৌদ্ধকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা । পুলিশ ও র‌্যাবের ক্রস ফায়ারে নিহত হয় ৪ জন এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত হয় ৩ জন। বছরের প্রথম চার মাসে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ১০ জন।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘এইবেলা ফাউন্ডেশান’-এর ১ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ৮৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এ সবের অধিকাংশ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার সংখ্যা কমপক্ষে ৫১০ । এছাড়া ২টি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম অবরুদ্ধ রয়েছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনটিতে।

এ সময়ে ১০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪২ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ৫ জন, জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৩৩টি। ২১৫টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, প্রতিমা ভাঙচুর ১৬টি, মন্ডপে হামলা ও চুরি ১০টি। বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে ৪১টি হিন্দু পরিবারকে। সম্পত্তি দখল ৪ হিন্দু পরিবারের, গণধর্ষণের শিকার ১ জন এবং বোমা হামলার শিকার ২টি পরিবার।

অপরদিকে এইসব হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। দুর্বৃত্তদের হাতে গত দু’মাসে ১০টি নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা উল্লেখ করে ৬ই জুন এক বিবৃতিতে এমন মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।

বিবৃতি প্রকাশ করতে গিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক চাম্পা প্যাটেল বলেন, যারা ইসলাম অবমাননা করে তাদেরকে অব্যাহতভাবে টার্গেট করে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর নির্লজ্জ ঘোষণায় এসব হত্যাকা- হচ্ছে। এসব ঘটনায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের আত্মতুষ্টিতে নাড়া লাগা উচিত।

অসহনশীলতার বিপক্ষে বাংলাদেশ সরকার মাঝে মাঝেই আত্মরক্ষার উপায় খুঁজেছে মন্তব্য করে চাম্পা প্যাটেল বলেন, কিন্তু তাদের গৃহীত কর্মকা- ইঙ্গিত দেয় অন্যকিছু। হত্যাকা-ের এই ধারা বন্ধ করতে তাদের শক্তি ব্যয় না করে, তারা নিরাপত্তা দেয়ার আহ্বান অগ্রাহ্য করছে।

যুক্তরাজ্যের ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম, ব্লগার হত্যা, সংবাদপত্র ও অনলাইনে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ‘কড়াকড়ি’ নিয়ে প্রতিবেদনটিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। গত এপ্রিল মাসে তারা এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল।

প্রতিবেদনে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সংঘাত, মুক্তমনা লেখক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক প্রতিবেদনে বলেছে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, গুম ও ব্লগার হত্যাকা-, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, দুর্বল কর্ম পরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার, গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ।

এছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন ও হয়রানি, বিচারের আগেই আটক রাখাকেও সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও ওই প্রতিবেদনে নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারে হস্তক্ষেপকেও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুদের কাজে বাধ্য করা, নারী ও শিশুর বৈষম্যের শিকার হওয়া এবং ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতার বিষয়গুলোও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রকাশ করা ২০১৫ সালের মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে এমন মন্তব্য করা হয়। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতরে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।

তবে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৫’র তীব্র সমালোচনা করেছে বাংলাদেশ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রই মানবাধিকার লংঘনে বিশ্বে সবার উপরে রয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে না বলে দাবি করেন এক সংবাদ সম্মেলনে।

কিন্তু বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনের সাথে সহমত প্রকাশ করেছেন দেশের মানবাধিকার নেতারা৷ তারা বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা, নিখোঁজ, গুমের ঘটনায় উদ্বিগ্ন৷

সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর (সুজন) সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেছেন, নাগরিক নিরাপত্তা এবং সুশাসনের পরিপন্থী সকল ক্ষেত্রেই আমরা সরকারের অবস্থান দেখতে চাই। খুন, গুম, গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি কারো জন্যই মঙ্গলকর নয়। অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতিতে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হয়। গণতন্ত্রের পথ হয় রুদ্ধ। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অশুভ শক্তিগুলো। এ অবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী কোনো নাগরিকের কাম্য নয়। তাই সরকারের উচিত হবে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে বস্তুনিষ্ঠ পদেক্ষেপ গ্রহণ করা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মানবাধিকার উন্নয়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারছে না। ফলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে; যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য অশুভ।