প্রবন্ধ
  রোযা: খোদাভীতি ও মানবতাবোধের শ্রেষ্ঠ দর্শন - আবুবকর সিদ্দীক
  02-06-2016

 

‘শান্তির বাণী নিয়ে হীম শীতল রবে

মাহে রমযান এলো তমশার ভবে।’

বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা মাহে রমযানে রোযা রাখা ফরয (অপরিহার্য) করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের বাণী-

‘হে বিশ্বাসী গণ, তোমাদের ওপর রোযা অপরিহার্য করে দেয়া হয়েছে। যেভাবে অপরিহার্য করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। সম্ভাবত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।’

(সূরা আল বাক্বারা-১৮৩)

আল কুরআনে ‘তাকওয়া’ শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

১. ভীতি

২. আনুগত্য

৩. পাপ মোচন।

এই তিনটি অর্থের সম্মিলিত রূপই তাকওয়া। অর্থাৎ জগৎরাষ্টা আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভয় রেখে তাঁর বিধানের ওপর পূর্ণ আনুগত্যশীল হওয়া এবং যাবতীয় পাপ বর্জন করাই হলো তাকওয়া। আর রোযা ফরয হওয়ার প্রধান কারণ হলো এই তাকওয়া অর্জন। কেননা, কারও ভিতর আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হলে তার পক্ষে গুনাহের কাজ করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার এই কারণটির সাথে যদি অন্যান্য কারণগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে সহজেই অনুমেয় হবে, রোযা খোদাভীতি ও মানবতাবোধের শ্রেষ্ঠ দর্শন।

 

রোযা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রণ করে আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনে সহায়তা করে। এ জন্যই আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মে রোযা বা রোযা জাতীয় উপাসনার নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা রিপুগুলোকে দমন করে খাঁটি পথে অবিচল থাকবে তাদেরকে অগণিত সওয়াব প্রদান করা হবে।’ (সূরা আল জুমার-১০)

রোযার মাধ্যমে ধৈর্য- সহিষ্ণুতা ও বিন¤্র স্বভাবের সৃষ্টি হয়। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার বন্ধ রেখে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধির মাধ্যমে রোযাদার অনাহারী ব্যক্তির কষ্ট অনুধাবন করতে পারে। যা তাকে গরিবের প্রতি দয়া প্রদর্শনে উৎসাহিত করে। মুমিনদের বৈশিষ্ট্যের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘যারা না দেখে বিশ্বাস করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদেরকে যে রিযিক দেয়া হয়েছে তা থেকে ব্যয় করে।’ (সূরা আল বাক্বারা-০৩)

রমজান মাসে একই সাথে ধনী- গরিব রোযা রাখার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার জন্ম হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই। অতএব, তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক যথাযত ভাবে পুনর্গঠিত করে নাও।’

(সূরা আল হুজরত-১০)

রোযা মানুষের চির শত্রু শয়তানের হামলা প্রতিহত করতে ঢালের ভূমিকা পালন করে। রাসূলে করিম (সঃ) বলেছেন, ‘রোযা ঢাল স্বরূপ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার সুরক্ষিত দুর্গ বিশেষ।’ (মুসনাদে আহমদ)

 

রমযান মাস কুরআন অবতীর্ণের মাস । আল কুরআন সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নিরূপনকারী। এ মাসে রোযা রাখার মাধ্যমে কুরআনের আলোকে জীবন গঠনের প্রেরণা সৃষ্টি হয়। মহান আল্লাহর বাণী, ‘রমযান মাসই হলো সেই মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানুষের জন্য জীবন বিধান এবং সত্য পথ যাত্রীদের জন্যে সুস্পষ্ট পথনির্দেশ।’

(সূরা আল বাক্বারা-১৮৫)

 

রমযানের রোযা বান্দার অতীত জীবনের সমস্ত পাপ মোচনের অন্যতম পন্থা। নবী (সঃ) এর বাণী,‘যে ব্যক্তি ঈমান ও চেতনা সহকারে রমযান মাসের রোযা রাখবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাপ হয়ে যাবে।’ (সহীহ আল বুখারী, ৩য় খ-)

রমযান মাস রহমতের মাস। এ মাসে রোযা রাখার মাধ্যমে বান্দার উপর রহমত অবতীর্ণ হয়। নবী করিম (সঃ) বলেন, ‘যখন রমযান মাস আসে তখন রহমতের দরজা খুলে দেয়া হয়।’ (সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম)

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সঃ) বলেন, ‘রমযান মাসে আমার (রোযাদার) উম্মতকে পাঁচটা বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছে যা পূর্ববর্তী কোন নবীর উম্মতকে দেয়া হয়নি। তা হলো-

১. রমযানের প্রথম রাতে আল্লাহ তায়ালা তাদের দিকে দৃষ্টি দেন। আর আল্লাহ যার দিকে দৃষ্টি দেন তাকে কখনো শাস্তি দেন না।

২. তাদের মুখে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় তা আল্লাহর নিকট মেশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক প্রিয়।

৩. রমযানের প্রত্যেক দিনে ও রাতে ফেরেশতারা রোযাদারের জন্য  দোয়া করে।

৪. আল্লাহ তায়ালা জান্নাতকে বলেন, তুমি আমার বান্দাদের জন্য সুসজ্জিত ও প্রস্তুত হও। আমার বান্দারা অচিরেই দুনিয়ারর দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে আমার বাড়িতে ও আমার সম্মানজনক আশ্রয়ে এসে বিশ্রাম নিবে।

৫. রমযানের শেষ রাতে আল্লাহ তাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন। (বায়হাকী)

 

রোযা শরীরে প্রবাহমান  পদার্থ সমূহের মধ্যে ভারসাম্য সংরক্ষণ করে। যেহেতু রোযার দ্বারা মানব দেহের বিভিন্ন প্রবাহমান পদার্থের পরিমান হ্রাস পায় তাই এদের কার্যক্রমে ব্যাপক প্রশান্তির সৃষ্টি হয়। এজন্যই প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেছিলেন, ‘তোমরা রোযা রাখ, সুস্থ থাকতে পারবে।’

 

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মূর পাল্ড দিল বলেন, ‘ইসলাম যদি স্বীয় অনুসারীদেরকে অন্য কিছু শিক্ষা না দিয়ে শুধুমাত্র রোযার ফর্মুলাই শিক্ষা দিত তাহলে এর চেয়ে উত্তম আর কোন নিয়ামত তাদের জন্য হতো না।’

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমল্ড নারায়ড বলেন, ‘রোযা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মুল করে।’

কুরআনুল কারীমের সূরা বাক্বারার ১৮৪ নম্বর আয়াতের শেষাংশ এই বিষয়গুলোর দিকেই ইঙ্গিত বহন করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

‘অ -ইন তাছুমু খয়রুল্লাকুম ইনকুনতুম তায়ালামুন- আর যদি (পীড়িত অবস্থায়ও) রোযা রাখ তবে তা বিশেষ কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝতে পারো।’

আল্লাহ তায়ালা রোযা রাখার মাধ্যমে গোটা মুসলিম জাহানকে তাঁর সন্তোষ, ভীতি ও মানবতাবোধ অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক- ধর্মীয় গবেষক, কবি, কলামিস্ট ও সহকারী সম্পাদক, মানবাধিকার খবর।