সারাদেশ
  নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা:) এর অবদান
  01-05-2016

গত পর্বে নারী ও নারীর অধিকার নিয়ে লিখেছিলাম। এই পর্বে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা করলাম।

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারী অধিকার :

 নিচে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারীর অধিকার আলোচনা করা হলো-

হিন্দু ধর্মমতে : হিন্দুদের ধর্মীর গ্রন্থ বেদ নারীর জন্য নিষিদ্ধ। ভারতে নারীর যে স্বতন্ত্র সত্তা আছে তা স্বীকার করা হতো না। সতীদাহ প্রথাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হিন্দুদের মধ্যে বহুবিবাহ উভয়দিক থেকে অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিডীয়, ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয় ও পারসিকদের মধ্যেও আপাতদৃষ্টিতে একজন পুরুষ কয়জন নারীকে বিবাহ করতে পারবে সে বিষয়ে কোন বাধা-বন্ধকতা ছিল না। এমন কি আধুনিক যুগেও একজন উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ যে কয়টি স্ত্রী গ্রহণ করতে চায় তার অধিকার তার রয়েছে।

বৌদ্ধ ধর্মমতে : নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারীর জন্য নির্বাণের কোন উপায় নেই।

ইহুদী ধর্মমতে : মুসা (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে ইসরাইলীদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। তারা একজন হিব্রু স্বামী কয়টি স্ত্রীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে সে বিষয়ে কোন সীমা নির্ধারণ না করেই এই প্রথা অনুসরণ করতো। পরবর্তীকালে জেরুজালেমের তামুদগণ স্বামীর পক্ষে যথাযথভাবে স্ত্রীর ভরণপোষণের শক্তির ওপর স্ত্রী গ্রহণের সংখ্যা নির্ধারণ করেছিল। যদিও ইহুদী পুরোহিতরা উপদেশ দিতেন যে, চারটির অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা যাবে না। তবু কেরাতিগণ তাদের সঙ্গে একমত ছিলেন না এবং তারা সীমা নির্ধারণের বৈধতা স্বীকার করতেন না। ধর্ম পারসিকদেরকে বহু বিবাহের জন্য উৎসাহিত করতো।

খৃষ্টান ধর্মমতে : একমাত্র নারীই মানবীয় পাপের জন্য দায়ী। সন্তজম ক্রাইম ষ্টম বলেন: নারী একটি অনিবার্য পাপ, একটি জন্মগত দুষ্ট প্ররোচনা। সমস্ত বর্বর পশুর মধ্যে নারীর মত ক্ষতিকর আর কিছুই নেই। টারটুলিন তার লিখিত একখানি গ্রন্থে জনসাধারণের অনুভূতিকে রূপ দিয়েছেন। যেখানে তিনি নারী জাতিকে “শয়তানের দ্বার, নিষিদ্ধ মোহর উন্মক্তকারী, ঐশী আইনের প্রত্যাখ্যানকারী, খোদার প্রতিবিম্ব, মানুষের ধ্বংসকারী হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ইংল্যান্ডের প্রাচীন আইনে পুরুষকে নারীর মালিক বলা হয়েছে। এমনকি স্বামী স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারত। পুরুষ এবং নারী একইরকম অপরাধ করলে নারীকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ ছিল এবং পুরুষের জন্য ছিল সামান্য শাস্তি। বর্তমান সময়ে ও ইংল্যান্ডের আইনে এমন অনেকগুলো দিক আছে, যাতে মনে হবে নারী পুরুষের দাসী। এখনো গীর্জায় বিয়ের সময় নারীকে শপথ নিতে হয় যে, সে সারাজীবন স্বামীর অনুগত থাকবে। দাসত্ব, অধীনতা এবং ঘৃণা লাঞ্ছনার ফলে নারীর মন থেকে আত্মসম্মানের অনুভূতি মিটে গিয়েছিল। পৃথিবীতে যে সে কোন অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তার জন্য কোন সম্মানের স্থান আছে, একথা সে ভুলে গিয়েছিল। পুরুষ তার উপর অন্যায়- অত্যাচার করাকে অধিকার মনে করত এবং নারী এসব পীড়ন সহ্য করাকে তার কর্তব্য মনে করত। তার মধ্যে দাসত্বের মনোভাব এমনভাবে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছিল যে, সে নিজেকে স্বামীর দাসী বানাতে গর্ব অনুভব করত এবং পতি আরাধনা তার ধর্ম ছিল।

ইসলাম তথা হযরত মুহাম্মদ (স)- এর অবদান ঃ এবার আমরা দেখব ইসলামে নারীর অধিকার কী? তার অবস্থান কোথায়? এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা কী? একজন নারীকে তার পূর্ণ জীবনের সামগ্রিক সময়টা ভাগ করলে দেখতে পাই যে, সে পর্যায়ক্রমে প্রথমে কন্যা, স্ত্রী এবং মাতার ভূমিকা পালন করে থাকেন এবং অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই আসে তার শিক্ষার অধিকার, তারপর পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিক অধিকার, বিবাহের অধিকার, কর্মেক্ষেত্রের অধিকার, অভিন্ন আইনের অধিকার এবং মত প্রকাশ এবং পরামর্শের অধিকার।

কন্যা হিসাবে নারীর অধিকার ও অবস্থান ঃ আইয়ামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকার যুগে কন্যা সন্তান ছিল লাঞ্ছনা ও অবমাননার পাত্র। জীবন্ত কন্যাকে তারা মাটিতে পুঁতে রাখতে সামান্য দ্বিধাবোধ করত না। কারো কন্যা সন্তান ভুমিষ্ট হলে কন্যার মাতা- পিতা লজ্জায় শির অবনত করে রাখতো। কারণ তারা মনে করত এই কন্যা দ্বারা তারা কখনোই কোন সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারবে না। বরং এই কন্যার (বৈবাহিক সূত্রে) জন্যই তাদেরকে অন্য কোন গোত্রের কাছে সারাজীবন নত হয়ে থাকতে হবে। গোত্র নেতৃত্বের যুগে এই হীন মানসিকতা তাদের জন্য ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। বর্বরতার এই চরম মুহূর্তে দয়ার সাগর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এসে কন্যা সন্তানকে ধ্বংসের অতল গহবর থেকে টেনে তুললেন এবং সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করে খোদায়ী নির্দেশ কামনা করলেন।

ওহী নাজিল হল : তোমরা দারিদ্রের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করো না। তোমাদের এবং তাহাদের আহার্য দিয়ে থাকি। জেনে রাখো যে, সন্তান হত্যা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য অপরাধ। কালাম পাকের এই নির্দেশ শুনে মুমিনগণ চমকে উঠলেন এবং কন্যা হত্যার নির্দয় অভ্যাস তারা চিরতরে বর্জন করলেন। নবী করিম (সা.) নিজেও বাণী প্রদান করলেন: “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যার প্রথম সন্তান কন্যা।” তিনি (সা.) আরো বললেন: যে ব্যক্তি দুটি কন্যা সন্তানকে লালন পালন করে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে, কিয়ামতের দিন আমি এবং সে হাতের দুটি আঙ্গুলির ন্যায় পাশাপাশি থাকব। তিনি (সা.) আরো বললেন: ‘যদি কারো কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং সে তাদের প্রতিপালন করে তাহলে তারা তার জন্য দোযখের প্রতিবন্ধক হবে।” অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে: যার তিনটি কন্যা সন্তান থাকবে, সে জন্য সে ধৈর্য ধারণ করে এবং নিজের সামর্থ অনুযায়ী তাদের ভালো পোশাক পরতে দেয়, তবে তারা তার জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে: কন্যা সন্তানের জন্ম পিতামাতার জন্য লজ্জাকর নয় বরং কন্যার প্রতিপালন ও হক আদায় করার দ্বারা তাদের বেহেশত লাভ হতে পারে।

চলবে...

মাওলানা মোহাম্মাদ আবু বকর সিদ্দীক আদ্দাঈ

লেখক: আলেমে দ্বীন ও ধর্মীয় গবেষক, ঢাকা